‘হাজার চুরাশির মা’ সুজাতা চ্যাটার্জী, দোপদী মেঝেন আরও অনেকে মূর্ত হয়ে ওঠে যে আগুনঝরা কলমে সেই কলম চিরতরে স্তব্ধ হয়ে গেছে ২৮শে জুলাই ২০১৬। মহাশ্বেতা দেবী আজ আর আমাদের মধ্যে নেই। দেশি বিদেশি পত্র পত্রিকায় লেখা হয়েছে,তাঁর মৃত্যু যেন ‘Vaccums Indian Literature’। Economist প্রবন্ধের শিরোনাম,’A writer of blood, forest and grief ।’ অরণ্যবাদী মানুষের জন্য তাঁর লেখনীতে রক্তপাত, আগুনের ফুলকি। সামাজিক সততা, পতন, সবার অভ্যুথ্থান নিয়ে তাঁর কলম দলিত, নিপীড়িত, অবহেলিত মানুষের জয়যাত্রার বার্তা শোনায়, শোনায় তাদের গোঙানি, কান্না, তুলে ধরে আয়না তথাকথিত শিক্ষিত সমাজের সামনে। তাই অতি সাধারণ মানুষগুলি রূপ পায় অনন্য সাধারণত্বে।
জন্ম ঢাকায়, ১৪ই জানুয়ারি ১৯২৬। বাবা কল্লোল যুগের কবি মনীশ ঘটক। মাও অত্যন্ত শিল্প মনস্ক সমাজসেবিকা ধরিত্রী দেবী। আর ছোট কাকা তো সকলের প্রিয় ও পরিচিত ঋত্বিক ঘটক। এইরকম পরিবারে জন্ম যাঁর, সাহিত্য ও সমাজভাবনা তো থাকবেই তাঁর রক্তকণায় বলাই বাহুল্য। দেশভাগের পর পশ্চিমবঙ্গে বাসা এবং কলকাতায় স্থায়ী বসবাস। স্বামী ছিলেন বিখ্যাত নাট্যব্যাক্তিত্ব বিজন ভট্টাচার্য। বিজন ভট্টাচার্য গণনাট্যের আন্দোলনের পথিকৃৎও। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ বিবাহবিচ্ছেদ হয়ে যায় কিছুদিন পর। একমাত্র ছেলে নবারুণ ভট্টাচার্য ছিলেন প্রথিতযশা কথাসাহিত্যিক । তবে অপরিণত বয়সেই তাঁর প্রয়াণ।
মহাশ্বেতা দেবী কলেজে পড়াশোনার পাশাপাশি সাহিত্যচর্চা করেন আজীবন। ক্রমশঃ প্রান্তিক মানুষের সামাজিক বঞ্চনা, শোষন ও নিপীড়নই হয়ে ওঠে তাঁর সাহিত্যের মুখ্য বিষয়বস্তু। ‘ অরণ্যের অধিকার ‘ ১৯৭৯ সালে সাহিত্য অকাদেমী পুরষ্কার পায় — এরপর তো পদ্মশ্রী, পদ্মবিভূষণ, জ্ঞানপীঠ (১৯৯৬), Magsaysay award – তালিকা চলতেই থাকে। সিনেমাও হয়েছে বেশ কিছু লেখা নিয়ে তাঁর, যেমন রুদালি, হাজার চুরাশির মা ইত্যাদি। একশটির ওপর উপন্যাস, গল্প এবং অজস্র ছোটগল্প লিখেছেন তিনি।
দলিত, অবহেলিত প্রান্তিক মানুষের রূপকার, তাদেরই অবরুদ্ধ কন্ঠস্বর, তাদেরই প্রতিবাদের বিচ্ছুরণে অঙ্গীকারবদ্ধ তাঁর লেখনী। দৃপ্তকন্ঠে তিনি বলেছেন, ‘It is not a human right, it is a right to a human and to be recognized as one.’ । ২০০৬ সালে Frankfurt Book Fair এ তাঁর বক্তৃতায় তিনি ফুটিয়ে তোলেন ভারতবর্ষের বিশালত্ব ও বৈষম্যের মাঝে যে নিবিড় ঐক্যতানের সুর বেজে ওঠে তাকে। তাই খাদির সঙ্গে মিনিস্কার্ট, রবীন্দ্রসঙ্গীতের সঙ্গে ব়্যাপ –তাঁর নিজের ভাষায়, ‘ …somewhere dark , somewhere light, somewhere saffron, somewhere green as the fields of new paddy … somewhere flecked with blood, somewhere washed cool by waters of a Himalayan spring …but still it holds, still it holds …’
গণধর্ষনে মহাশ্বেতা দেবীর ‘দোপদী মেঝেন ‘ তাই করুণ, নিপীড়িত, পরাজিত নয়। পেছনের পায়ের শব্দ বুটের আওয়াজ তোয়াক্কা না করে সে নির্ভয়ে তিন মাইল জঙ্গল ঢাকা বিস্তীর্ণ পথ ধরে এগিয়ে চলে, রক্তমাখা থুতু ছুঁড়ে দেয় সেনানায়কের সাদা বুশ শার্টে ঘৃণাভরে –কাপড় সে পরবে না। কেনই বা পরবে ? সে বলে,’হেথা কেউ পুরুষ নাই যে লাজ করব। কাপড় মোরে পরতে দিস না।’ তারপর তার ধর্ষিত মর্দিত স্তন দিয়ে সেনানায়ককে ঠেলতে থাকে ঘৃণাভরে –নির্ভয়ে । মহাশ্বেতা দেবীর কলমে দলিত, অত্যচারিত হয়ে ওঠে পরাক্রমশালী, নির্ভীক, প্রতিবাদে সোচ্চার । আর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নগ্ন বাস্তবে অত্যাচারী সেনানায়ক এই প্রথম কোনো নিরস্ত্র ব্যক্তির সামনে ভয়ে সিঁটিয়ে ওঠে! সিঁটিয়ে ওঠে সমাজও — রক্তে, প্রতিবাদে বিষন্নতায় ।’A writer of blood, protest and grief ‘–যার অপর নাম ‘মহাশ্বেতা’।
Reviews
There are no reviews yet.