সে এক আশ্চর্য আলাপের মুহূর্তে এলার একান্ত নিবেদনের বিপরীতে দাঁড়িয়ে কঠিনহৃদয় অন্তু জানিয়ে দিয়েছিল, ফেরার উপায় নেই। তির লক্ষ্যভ্রষ্ট হতে পারে, কিন্তু তা আর তূণে ফিরতে পারে না। তবু শেষ পর্যন্ত একবার সে শুনতে চেয়েছিল, এলা তাকে বলুক, ভালোবেসেছি। কামনা করে — “বলো আমি তোমাকে ভালবেসেছি, সে-কথা তোমার মনে থাকবে, আমি যখন থাকব না তখনো।” এই সেই অলৌকিক মুহূর্ত যখন সমস্ত যুদ্ধ, সমস্ত বিপ্লব-প্রত্যাশা এক লহমা থমকে যায় ফুটে ওঠা বসন্ত-কুঁড়ির দিকে তাকিয়ে। রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে, যুদ্ধে ক্লান্ত সভ্যতা জানে, যে কোনও নির্মমতা বরণ করে নেওয়াই তার নিয়তি, তবু সমস্ত সম্মানজনক ক্ষতের অর্জন নিয়ে সে একবার অন্তত দাঁড়াতে চায় এই ভালবাসার পবিত্রতম প্রদেশে। সেটুকুই স্বদেশ। বাকিটা পরবাস। বাকিটা তত্ত্ববিশ্বের সংঘাত, শ্রেণির দ্বন্দ্ব, ধর্মের উন্মাদনা, চেতনার অবলুপ্তির আখ্যান। হুমায়ূন কবিরের উপন্যাস ‘পারস্য পরবাসে’-র বিপ্লবী মাসউদও হয়তো মনে মনে জানত তার প্রিয়তমা আনুশেহ, হাফিজের কবিতার মতোই সেই শুদ্ধতমা রহস্যময়ী, তাকে ভালোবাসবে, তার না থাকার পরেও। কিন্তু এ কথা সে শুনবে কেমন করে? শুনবে না। শুনবেন, তরুণ ডাক্তার হুমায়ূন কবির স্বয়ং। যিনি লেখক, আবার এ উপন্যাসের এক চরিত্রও বটে। যিনি স্বদেশকে ধারণ করেই পাড়ি দিয়েছেন পরবাসে। তিনি কি গোপনে ভালবাসতেন না আনুশেহকে? আর কী আশ্চর্য, সমস্ত দূরত্ব, সমস্ত সংযমের পরও কী করে যেন সে কথা জেনেই গিয়েছিল আনুশেহ। তবে তার প্রকাশ হল এমন সময়, মাসউদ শহিদ হওয়ার পর এমন মুহূর্তে এই একান্ত গোপনে লালিত ভালোবাসার কথা বেরিয়ে আসে, যখন তা আর্তনাদের সমতুল। যখন গোপনে কেঁপে ওঠা ছাড়া আর কিছু করার থাকে না। এই কেঁপে ওঠাটুকুই শাশ্বত। রণক্লান্ত সভ্যতা সমস্ত অর্জন-সফলতার পরেও এক জীবনে প্রত্যাশা করে এই কেঁপে ওঠাটুকু।

হুমায়ূন কবির খুব সরল বর্ণনায় এই সারসত্যটুকু তুলে ধরেন তাঁর উপন্যাস ‘পারস্য পরবাস’-এ। এ উপন্যাস নিছক ভ্রমনকাহিনি বা আত্মজীবনী নয়। এ আসলে উপন্যাসই। লেখক দক্ষতার সঙ্গে নিজেকে উপন্যাসের মধ্যে স্বনামে রেখেও দূরত্বের খড়ির দাগ টেনে দিয়েছেন। গল্প জানায়, এক তরুণ বাঙালি ডাক্তার গিয়ে পৌঁছেছেন পারস্যে, যেখানে তাঁর পরিচয় হবে আনুশেহর সঙ্গে। সেই আনুশেহ, যে এই বাঙালি যুবকটির পরিচয় করাবে হাফিজ ও রুমির সঙ্গে। আনুশেহ না থাকলে এই বাঙালি হয়তো উপলব্ধি করতেন না সুফি সাধকের কবিতাপাঠও কীরকম ধর্মগ্রন্থ পঠনের মতো পবিত্রতম অনুভূতি হয়ে ওঠে। সুফি দুনিয়ার এই উদারতা, এই মৌতাত অবশ্য অনুভবের প্রদেশে। কারণ বাইরের পৃথিবী তখন দেখছে যুদ্ধ, দ্বন্দ্ব, শিয়া-সুন্নি আক্রমণে বিপর্যস্ত মানব সভতা। লাশ ও রক্তের উপর দাঁড়িয়ে কোথাও যেন এক হয়ে যাবে দেশে দেশে সমস্ত যুদ্ধের বিবরণী। হয়তো তা বাংলাদেশ, ভারত, পারস্য, কিংবা অন্য কোনও দেশ, যেখানে থাবা বসিয়েছে যুদ্ধ। অথচ, হুমায়ূন স্পষ্টই উপলব্ধি করবেন, আনুশেহর জন্যই উপলব্ধি করবেন, সেই বুক মোচড়ানো ভালোবাসাকে, যা যুদ্ধকে হারিয়ে দিতে পারে এক ফোঁটা অশ্রুতে। আনুশেহ ফলে শুধু এক চরিত্র থাকে না। রণরক্তসফলতার পৃথিবীতে সে এক আশ্চর্য নারী হয়ে ওঠে, যার কাছে রাখা আছে সভ্যতার শ্রূশুষা।

এ উপন্যাসও আসলে সেই ভূমিতেই পৌঁছে দিতে চায় পাঠককে। ইতিহাস ঘুরে ঘুরে চরকিপাক খায় কি ক্ষমতা অর্জনের জন্য? বোধ হয় না। সে অপেক্ষা করে এই সময়চেতনার উপর দাঁড়িয়ে আশ্চর্য ভালোবাসা হয়ে ওঠা গানের জন্য। এই উপন্যাসের শেষে কোনও এক তরল জোছনার অবগাহনে পাঠক নিশ্চিতই শুনতে পাবেন সেই সুর। সে পৃথিবীতে মানুষ কোনও কথা বলে না। শব্দ থাকে না। নৈসর্গিক নৈশব্দ যে পৃথিবীতে মুছে দেয় পরবাসের পরিসীমা। জানিয়ে দেয়, মানুষের জন্য আছে শুধু এক ও একমাত্র ভালোবাসার দেশ।

Weight 0.3 kg
Dimensions 21 × 18 × 2 cm
Author Name

Binding

Language

Publisher

Publishing Year

2023

Reviews

There are no reviews yet.

Be the first to review “Parasya Parobase || Humayun Kabir”

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Recently Viewed

  • Recently Viewed Products is a function which helps you keep track of your recent viewing history.
    Shop Now
Parasya Parobase || Humayun Kabir
Original price was: ₹149.Current price is: ₹134.

Only 5 left in stock

Estimated delivery on 25 - 30 September, 2024