রবীন্দ্রনাথের ‘ভুল স্বর্গ’ গল্পের সেই নেহাৎ বেকার লোকটির কথা মনে আছে?
তার কোনো কাজ ছিল না—কাজ যে করবে তার সময়ই ছিল না মোটে। কেবল শখ ছিল নানারকমের—মাটির ওপর ছোটো ছোটো ঝিনুক সাজিয়ে সে এঁকে তুলতো ছবি। বাড়ির লোক ও পরিজন-প্রতিবেশের কাছে সে ছিল মূর্তিমান উৎপাত। সমস্ত জীবনটা তার অকাজে গেল। মৃত্যুর পর স্বর্গীয় দূতেরা মার্কা ভুল করে তাকে রেখে এল কেজো লোকের স্বর্গে। সেখানে সকলেই কাজ করে, সেখানে সবই আছে নেই শুধু অবকাশ। এ বেচারা কোথাও ফাঁক পায় না, খাপ খায় না।
একদিন স্বর্গের উৎসতলায় ঘড়া-কাঁখে জল নিতে আসা মেয়েটির সঙ্গে তার দেখা হয়ে যায়। ভারি ব্যস্ত । মেয়েটির ঘড়াটি চেয়ে নিয়ে তার গায়ে সে চিত্র করে দেয়। সেই আলিম্পনে কত রঙের পাক কত রেখার ঘের।
রাতে মেয়েটি বিছানা ছেড়ে দীপের আলোয় বার বার ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে চিত্রটা দেখতে লাগল—তার বয়সে সে এই প্রথম এমন কোনো কাজ দেখল যার কোনো মানে নেই।
এর পরে সেই বেকার লোকটি মেয়েটিকে রঙিন সুতো বুনে বুনে বানিয়ে দিল বেণী বাঁধবার দড়ি।
এখন উৎসতলায় এলে মেয়েটির ব্যস্ত পা-দুটি কোন অভাবিতপূর্ব ছন্দে শ্লথ হয়ে আসে, আয়না হাতে বেণী বাঁধতে তার হয়ে যায় দেরি।
কেজো স্বর্গে সমস্ত কাজে, ব্যস্ততার মধ্যে বড়ো বড়ো ফাঁক দেখা দিল। চিন্তিত স্বর্গীয় প্রবীণেরা সভা ডাকলেন। স্বর্গের দূত এসে অপরাধ স্বীকার করল—বেকার লোকটিকে ভুল স্বর্গে আনা হয়েছে। ভুল লোকটিকে সভায় আনা হলে তার রঙিন পাগড়ি আর কোমরবন্ধের বাহার দেখে সকলেই বুঝল বিষম ভুল হয়েছে। লোকটিকে পৃথিবীতে ফিরে যাবার আদেশ দেওয়া হলো।
লোকটি তৎক্ষণাৎ হাঁফ ছেড়ে রঙের ঝুলি আর তুলি কোমরে বেঁধে ফিরে যাবার জন্য প্রস্তুত হলো। উৎসতলার সেই মেয়েটি এসে আমাদের সেই বেকার লোকটির সঙ্গে পৃথিবীতে যেতে চাইল।
প্রবীণ সভাপতি অন্যমনস্ক হয়ে গেলেন। এই প্রথম তিনি এমন এক কাণ্ড দেখলেন যার কোনো মানে নেই।
আমাদের এই সংকলনটিও ‘এমন এক কাণ্ড’ যার কোনো মানে নেই। আমাদের সংগৃহীত লুপ্ত বা বিলুপ্তপ্রায় স্মৃতি-আচ্ছন্ন পেশা ও বিগতায়ু পেশাদারদের কথা পাঠ করে স্বর্গীয় পাণ্ডারা গলা মোটা করে বলবেন—আরে বাপু পরিবর্তনই তো জগতের নিয়ম। চাকাদের তো গড়ানোই নিয়ম। যত দ্রুত গড়ায় ততই তো ভালো। কাদের গায়ের ওপর দিয়ে, কোন জনপদের সুখ-সমৃদ্ধি বিনষ্ট করে, মানুষের কোন অর্জনের বহির্লোকের রূপ আর অন্তর্লোকের সৌরভ ধ্বংস করে, কাদের চোখের জলের মহামূল্য ঋণের অস্বীকৃতিকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে, কোন জাদুঘরের ‘সমাজ’ নামে মার্কা-দেওয়া আইটেমসহ মানবগোষ্ঠীর বিলুপ্তিকে সুনিশ্চিত করে সেই চক্র চলে যাবে—তা দেখার দরকার নেই। এটাও দেখার দরকার নেই যে, চাকাটি সামনে এগোচ্ছে, না পেছন দিকে গড়াচ্ছে। প্রকাশ্য আর গোপন প্রকল্পগুলির ছাঁচ কাদের পাষাণে পরিণত করছে তা-ও দেখার দরকার নেই। অথবা এসব দেখেশুনে কারও কারও কারও মনে রবীন্দ্রনাথেরই পোস্টমাস্টারসুলভ জগৎ ও জীবনের অনিত্যতা-বিষয়ে দার্শনিকতা এবং তজ্জনিত গভীর, মহার্ঘ ঔদাস্যও জেগে উঠতে পারে। সুতরাং যা গেছে, যা যাচ্ছে, আরও যা যা বিলীয়মান—সেসবকে এবং জাতি-বর্ণ-দেশ-কাল নির্বিশেষে মানুষ যা কিছুকে চিরকাল তার নিজের আত্মরূপ বলে গ্রহণ করে এসেছে হয়তো তার বিনষ্টিকেও আধুনিক ভোজনশালার স্বাস্থ্যনাশক একপাত্র দুরাহার্যের মতো উদগার বলে মনে করতে পারে!
শিল্প থেকে কারিগরিতে পরিবর্তনের, বিজ্ঞান থেকে প্রযুক্তিতে পরাশ্রয়ের বিশ্বধারা-স্রোতে যারা ভেসে গেল, যারা শ্রম-বিশ্রাম-আনন্দের এক এক অর্জিত আট ঘন্টাকে রক্ষা করার চেষ্টামাত্র না করে চব্বিশ ঘন্টার সময়পিণ্ডসহ তাৎক্ষণিক লাভালাভের নিরবচ্ছিন্ন অঙ্কের, নিরবয়ব শূন্যতার মহাকৃষ্ণবিবরে প্রবেশ করল, যারা তুচ্ছ দিনানুদিনের জন্য আত্মাকে বন্ধক রাখল—তাদের সকলের জন্য শোকগাথা নয় এই সংকলনটি।
আজকের তিমিরক্রূর বাস্তবতায়, নিরালোকে, এই গতি-উন্মাদ স্থবিরতায় আমাদের সেই বেকার লোকটি কি সহজে পৃথিবীতে ফিরে আসতে চাইবে? মেয়েটি কি সত্যিই স্বর্গসুখ ত্যাগ করে লোকটির সঙ্গে ধরণীর এককোণে স্বর্গ গড়ে তুলতে আসবে?
কিন্তু বিশ্ব-ইতিহাস তো বানানো হতে পারে না। তাকে যে আসতেই হবে।
সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়
প্রচ্ছদ : সুলিপ্ত মণ্ডল
অলংকরণ : অদ্বয় দত্ত
Reviews
There are no reviews yet.