“তোমার পরশ লাগে হিয়া তনু মাঝে/ও হে নরহরি এসো নিত্য নিতুই কাজে / সখেরও জীবনও ঠেলে গেয়ে উঠি পাড়ে/প্রেমের ধরনী সুধা বাজে মন মাঝে”
কার্তিক মাসের ভোরে বালকরোদ তখনও ফোটেনি। নদী পাড়ের দূরের কোনো গ্রাম থেকে ভেসে আসছে এক ভেজা মনঃপ্রাণের সুর। মাটির সেই সুরে বাজছে প্রেমের আকুতি! আর্তচিৎকারের কাঁপুনিতে গায়ক নিজের নিজেকে নিবেদন করছেন, অশ্রুসিক্ত গলায়! কী এক নিস্তব্ধ অনুভূতি খেলে যাচ্ছে ভিতরে বাইরে । জীবনের সকাল বেলায়, প্রতিদিন এভাবেই সাধক তৈরি করেন নিজের নিজেকে! নিজের ভিতরেই বাজে সুরের কলি সূর্যোদয়ের আগে, ভোরের হাওয়াতে সে সুর চলে যায় দূরে আরও দূরে, মনের ভেতর, গহীন গাঁড়ায়! গৃহবাসী দ্বার খোলে, সাধকের জাগানিয়া গানের টানেই! প্রেম মঞ্জুরি বাজে হৃদয়ের ঘরে!
বৈষ্ণবীয় সাধক সাধিকারা তাঁদের আরাধ্য মনচোরাকে ডাকেন, সাধনের টহল সুরে! সুরের গভীরে গিয়ে নিজের নিজেকে জাগিয়ে তোলার এই আপ্তবাক্যের সাধনা তত্ত্বই রাঢ় বাংলার আদি এই সাধন সংগীত টহল। আজ বাংলা ও বাঙালির টহল! টহলকারীর দেহ মন্দিরের আদল পরিবর্তনের জন্য অপেক্ষা করেন! আর সেই পরিবর্তনের পথই টহলের সুরে নিজের নিয়তির চালে হয় নির্মাণ ! এই টহল মনের আমিকে জাগানোর গান!
সহজিয়া বৈষ্ণব সাধক সমাজের মানুষেরা, কার্তিকের হিম শীতল ভোরে উঠে শয্যা ছেড়ে গ্রামের দ্বারে দ্বারে ঘোরে মাধবের নামগান গেয়ে। বৈষ্ণব পদাবলির সেই সব আত্মনিবেদনের গানকেই বলে ‘টহল’ বা ‘জাগানো’।
এই বইয়ের আলোচনাতে গবেষণার বিষয় হয়ে উঠেছে সেই “টহল” গান আর গানের শিল্পীদের সাধক জীবনের নানা বাঁক বদল। বিভিন্ন বৈষ্ণব ডেরায় আজও এই আপ্তকথার চর্চা চলে সুরে ও গদ্যে! সে সব আপ্তবাক্যের সাধন তত্ত্ব নির্ভর সংযমের কথাই তুলে এনেছেন গবেষক রাধামাধব মণ্ডল, তাঁর এই “বাংলার টহল গান” বইটিতে। দেহের চৌকাঠে দাঁড়িয়ে আত্মদর্শনের এই বৈষ্ণবতত্ত্ব গীত টহল ও তার শিল্পীদের জীবন যাপন আপনার মনের মরমিআনায় সুধাচেতন জাগাবেই!
Reviews
There are no reviews yet.