ভোরবেলা পাকশালাগুলি থেকে ধূম উদ্গীরণ হচ্ছিল। শকুনি ধীরে ধীরে হাঁটছিলেন। যাবেন হস্তিনাপুরের মূল ফটকের বাইরে। বসবেন নদীতীরে। হাঁটতে হাঁটতেই তাঁর মনে হচ্ছিল হস্তিনাপুরের শরীরে আজ অসম্ভব উত্তেজনা। সে উত্তেজনা ধূম্ররূপে যেন প্রকাশ পাচ্ছে। গতকাল সায়াহ্নে ইন্দ্রপ্রস্থ থেকে পাণ্ডবেরা এসে পৌঁছেছে।
হস্তিনাপুরবাসীদের উত্তেজনা স্বাভাবিক। জতুগৃহ থেকে দ্রৌপদী বিবাহ -এ সব পর্বের পরে পাণ্ডবেরা এসেছিল। কিছুকালের মধ্যেই তারা যখন চলে গেল তখনও তারা দুর্বল। রাজনৈতিকভাবে অন্তত হস্তিনাপুরের মর্যাদা বেশীই। ইন্দ্রপ্রস্থ আরেকটি নগর বড়জোর, কোনোভাবেই হস্তিনাপুরের সঙ্গে তুলনীয় নয়। সেই ইন্দ্রপ্রস্থ আজ মর্ত্যে স্বর্গলোকের মর্যাদা পাচ্ছে। খালি পায়ে হস্তিনাপুরে হেঁটে প্রবেশ করা বালকটি এখন রাজসূয় যজ্ঞকারী রাজা যুধিষ্ঠির।
হস্তিনাপুর অনেককাল হল দুভাগে বিভক্ত হয়েই আছে ভেতরে ভেতরে। পাণ্ডব পক্ষ আর কৌরব পক্ষ। বস্তুত পাণ্ডব ভায়েদের হস্তিনাপুর আগমনের কিছুকালের মধ্যেই এমনভাবে বিষয়টি এসে দাঁড়িয়েছে, যাতে পাণ্ডবেরা কৌরবদেরই একটি শাখা – এমনটা আর থাকছিল না। বরং দুর্যোধন তথা ধার্ত্যরাষ্ট্রীয়দের সঙ্গে তাদের পার্থক্য পরিচ্ছন্ন হছিল প্রতিটি বিরোধে। এই বিভাজনটি যখনই জনমনে স্থায়ী ছাপ ফেলে তখনই একটি পুরাতন বংশও নতুন বংশের চেহারা নেয় ভিন্ন নামে। এ যেন এক নদী থেকে সৃষ্ট উপনদী একদিন সেই নদীকেই অস্বীকার করে স্বতন্ত্র নদী হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ভরত বংশ বলতে শুধু কাহিনী আছে, আর কিছু অবশিষ্ট নেই। মহারাজ কুরুর নামে কৌরব বংশই চলছে এখন। লোককে মনে করিয়ে দিতে হয় এই বংশ একদা ভরত বংশ ছিল। তেমনই একে পুরু বংশও আর একে কেউ বলে না আজকাল।
কালে কালে পাণ্ডবরা আরেকটি বংশের স্বীকৃতি পাবে এই প্রেক্ষিত এখন তৈরী হয়েই গিয়েছে। এখন হস্তিনাপুরবাসীরা জানতে উৎসুক কোন পক্ষ জয়ী হবে এই দ্বন্দ্বে! অথবা দুপক্ষ একপ্রকার সমঝোতা করেই চলবে কি না! যদি সমঝোতা হয় তাহলে বাসিন্দাদের এখনই পক্ষ বেছে নিজেদের ভবিষ্যৎ ভাবতে বসতে হবে না। কিন্তু সমঝোতা না হয়ে দ্বন্দ্ব বাড়লে ভাবতে হবেই। আর কে না জানে দুই রাজত্বের মধ্যে দ্যূতক্রীড়া আদপে যুদ্ধই। শুধু যুদ্ধক্ষেত্রের পরিবর্তে তা অধিদেবনা বা পাটাতে হবে। অধিদেবনা, সভাস্থলে প্রস্তুত করা হয়েছে। সেখানে সামান্য অংশকে মেঝের তল থেকে নীচু করা আছে। সেইখানে যদি বাদামী বভ্রুফল ছোঁড়া হয় তাহলে তা অন্যত্র ছড়িয়ে পড়বে না। সেখানেই হবে গণনার যুদ্ধ। আর এই যুদ্ধে কৌরবপক্ষের যোদ্ধা শকুনি স্বয়ং।
আজ যে বিপুল চেহারায় ‘মহাভারত’-কে আমরা দেখি তা চিরকালই এমন ছিল না। কালের প্রলেপ পড়েছে তার চেহারায়। অজস্র কাহিনি উপকাহিনিতে বহর বেড়েছে। প্রথম যে কালে এর ভাব ও বীজ জন্মেছিল সে কালের চেহারা আজ অনুমান করা কঠিন। কুরু-পাণ্ডব দ্বন্দ্বকেই এর মূল আখ্যানভাগ ধরা চলে। তাকে কেন্দ্র করে নানা কালের নানা কবিদলের দায় হয়েছে নীতি ও আদর্শ শিক্ষা বিস্তারের। কলেবর বেড়েছে, প্রক্ষেপ হয়েছে, নবীন কাহিনি অংশ যুক্ত হয়েছে, পরিবর্ধিত ও সংস্কৃত হয়েছে। সবই হয়েছে কালের নির্দিষ্ট প্রয়োজনে।
বাংলায় মহাভারতের অনুবাদ আছে, ভাবানুবাদ আছে, টীকা-টিপ্পনি আছে, মহাভারত নির্ভর নানা উপন্যাস ও কাব্যমালা রয়েছে, তৎসত্ত্বেও এই নবীন ‘মহাভারত’-এর আয়োজন কেন? শুদ্ধসত্ত্ব ঘোষ রচিত এই ‘মহাভারত’ অলৌকিকের হাতছানি এড়িয়ে বিগত ভারতবর্ষের সামাজিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক এক লোকায়ত চলচ্ছবি রচনা করে চলেছে যা অনেকাংশেই নবীন। কবি সঞ্জয়, কবীন্দ্র পরমেশ্বর, কাশীরাম দাসাদির পরম্পরায় ‘মহাভারত’-এর এ এক যুগোপযোগী পুনঃনির্মাণ।
এ ‘মহাভারত’ পূর্বতন যাবতীয় ‘মহাভারত’-এর সীমানা ছাড়িয়ে কাহিনি, চরিত্র, দর্শন, বিজ্ঞান এবং ইতিহাসগত অনুপুঙ্খতায় এগিয়ে চলেছে অভাবনীয়র দিকে। বিপুল বিস্তৃত এ কাজের সমাপ্তিও ঘটবে অভূতপূর্বতায়।
Reviews
There are no reviews yet.