গেল শতকের ত্রিশের দশকে বাঙালি সন্তান প্রবোধকুমার তীর্থযাত্রায় বেরিয়েছিলেন৷ গন্তব্য ছিল দুর্গম কেদারনাথ,বদ্রীনাথ। সেই “মহাপ্রস্থানের পথ”-এ যাত্রার বিচিত্র অভিজ্ঞতাই এই বইয়ের মূল আকর্ষণ। বইটি বেশ সাড়া জাগিয়েছিল বলেই মনে হয়। দৃষ্টি কেড়েছিল গুণীজনদের। তার প্রমাণ বইটি নিয়ে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ও প্রমথ চৌধুরীর সংক্ষিপ্ত আলোচনা।
সব ছেড়েছুড়ে লোটাকম্বল, লাঠি আর সামান্য অর্থ নিয়ে লেখক বেড়িয়ে পড়লেন তীর্থযাত্রায়। সেই ঘর ছেড়ে বেরুনোর কারণ শুধু পুণ্যলাভ নয়৷নিত্যদিনের জীবনের সুশ্রীদিকের বিপরীতে যে রূঢ়টা থাকে তা থেকে মুক্তির অভিপ্রায়েই এই বন্ধুর পথে অভিযান।
গেরুয়াধারী প্রবোধকুমার কেদারনাথ পথে যাত্রা শুরু করলেন৷ সারা ভারতবর্ষের বিচিত্র ধরনের, বয়সের, মনের মানুষের গন্তব্য কেদারনাথ। তখন ইংরেজশাসন। এখনকার মতো যাত্রাপথ সহজগম্য হয়নি। যাত্রীদের বেশিরভাগই বৃদ্ধা, আছে গাঁজাখোর সাধু,আছে রিক্তহস্তের পুণ্যর্থী। যেতে হয় তাই যাচ্ছে এমন তীর্থযাত্রীও আছেন দলে। যিনি পতিতা তারও গন্তব্য পুণ্যার্জন।
দুর্গম সেই পথ। পাহাড়ি চরাই-উৎরাই পেরুতে পেরুতে পা ক্ষয় হয়ে গেছে।বিষাক্ত মাছির অত্যাচার আর বিশ্রামের অভাবে সবাই যেন শ্রান্ত। সেই ক্লান্তি আর একঘেয়ে পথচলা পুণ্যার্থীদের করে তুলেছে রুক্ষ।লেখক লক্ষ করেছেন সামান্য তিক্ততা তো দূরে থাকুক, ভালো কথাও শুনলে শরীরে রাগ চড়ে যাচ্ছে। দল বেঁধে যাচ্ছেন সবাই। এখানেও কথা আছে। যাদের ট্যাঁকে পয়সা আছে, তারা কুলির কাঁধে চড়ে যাচ্ছে। একসাথে গল্প করতে করতে আগাচ্ছে। পুণ্যার্জনের পথে যেতে যেতেও কুৎসা, সমালোচনা রসিয়ে রসিয়ে করছে লোকে। গলায় গলায় ভাব থাকা সত্ত্বেও ব্রাহ্মণ যাত্রীর সাথে নীচুজাতের সঙ্গীর বিভেদ ঘোচেনি।
দিনশেষে দল বিশ্রামের জন্য থামলো।সবাই যে যার মতো রান্না চড়িয়ে দিল। খেয়েদেয়ে ঘুম। অথচ সেইদলেরই কোনো যাত্রী আটাগুলে খেয়ে আছে। তা দেখবার সময় কারো নেই। সবাই দুর্লঙ্ঘকে পাড়ি দিয়ে ঈশ্বরকে খোঁজ করতে ব্যস্ত৷ মানবপ্রকৃতির রহস্যময়, দ্বান্দ্বিক দিকগুলোতে বারবার আলো ফেলেছেন প্রবোধকুমার। দেখেছেন অসুস্থ সহযাত্রীকে মৃত্যুর মুখে রেখেই রওনা হয়েছে সবাই। কারো মিনিটকতক সময়ও নেই ব্যয় করবার। লক্ষ করেছেন ধর্মের নাম ভাঙিয়ে তীর্থযাত্রীদের কীভাবে একদল লোক শোষণ করে আসছে।
যাত্রাপথেই প্রবোধকুমারের সাথে পরিচয় হলো রাণীর। এই তরুণী বিধবা। সদাউচ্ছ্বল এই তরুণী ঘোড়ায় চড়েই চলেছে তীর্থপানে। রাণী চরিত্রটিকে বিশেষ যত্নে এঁকেছেন প্রবোধকুমার। তরুণী সুশ্রী হিন্দু বিধবাকে সমাজ প্রতি মুহূর্তে আক্রমণ করতে আসে। সমাজের সেই আক্রমণকে প্রবোধ দেখিয়েছেন রাণীর দূরসম্পর্কের মাসির মাধ্যমে, যে সবসময়ই রাণীকে সন্দেহ করে। যে ভাবে নারী-পুরুষের আদিতম সম্পর্কের বাইরে অন্য কোনো শুভবোধ বাঁধনের অস্তিত্ব নেই। সবাই চলছে ঈশ্বরের সন্ধানে অথচ প্রবোধকুমারের দৃষ্টি এড়ায়নি তরুণী রাণীকে দেখছে অন্য চোখে।
এই রাণীর সাথে সম্পর্ক সত্যিই কি ছিল? কতটা নিবিড় ছিলেন লেখক তা নিয়ে প্রশ্ন করার একটি সুযোগ কেন যেন রেখে দিয়েছেন লেখক।
– Aditi Sannigrahi
Good one