সাহিত্যের চালচিত্র কলমে “শিল্পাঞ্চলের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় আদিবাসী জীবন নিয়ে লেখা একাধিক গল্প, নিবন্ধ সাহিত্যরসিক জনের দৃষ্টি আকর্ষন করেছে। কয়লার সঙ্গে তাঁর জীবিকা জড়িয়ে থাকলেও শ্রী শিবরাম পড়া মনে করেন সাহিত্য এক ধরনের খনিজ রত্ন। শ্রী পড়ার সাহিত্যের কাজকর্মের ধরণ গবেষণাধর্মী। সাঁওতাল জীবনযাত্রা খুব কাছ থেকে দেখেছেন। ফলে তাঁর লেখায় মাটি ঘেঁষা বনজ গন্ধ বেশ পাওয়া যায়। শুনে ভাল লাগল পভাবাবু সংগ্রহে অর্ধশত সাঁওতালি গান রয়েছে। এগুলো নিয়ে তরুণ সাহিত্যপ্রিয় মানুষটির কাজ করার ইচ্ছে আছে। আমাদের দেশে রিসার্চ ইউনিভার্সিটি বলে কিছু নেই। থাকলে তাদের মাধ্যমেই এই সব সৃজনশীল লেখকরা যথার্থ মর্যাদা পেতেন।” (পশ্চিমবঙ্গ সংবাদ- ০৮/০৪/১৯৮৫)
লেখক থেমে থাকেন নি, গবেষণাধর্মী লেখাগুলি জাতীয় পত্রিকা’ সংবাদ পরে ২০০০-২০০১ এ ‘সাঁওতালি গান ও বিবাহ রীতি’ শিরোনামে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছে। মননশীল লেখক অনুভব করেছেন পাশ্চাত্য সংস্কৃতির জড়বাদী প্রভাবে ভারতীয় সংস্কৃতি ক্ষয়িষ্ণু। ফিরে ফিরে যেতে হয় শিকড়ের টানে অরণ্যবাসী ভূমিপুত্রদের আঙিনায়। যাঁদের চেতনায় আজও সত্য শাশ্বত মূল্যবোধ গ্রথিত। অভিজ্ঞতালৰ পরিণত চেতনায় আন্তরিক অভিব্যক্তির প্রকাশ এই গ্রন্থখানি। মৌলিক সাহিত্য হিসাবে ভারতীয় সংস্কৃতিতে সাঁওতালি সংস্কৃতির অবদান অনস্বীকার্য। লেখক বৃহত্তর সমাজের সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপনের প্রচেষ্টায় সফল। কেননা ক্ষেত্রসমীক্ষাজাত প্রতিটি গানের সংগ্রহ, প্ররোগ তথা রীতিনীতির ব্যাখ্যা মৌলিক লোকসংস্কৃতির আঙিনাকে বিস্তৃতিদান করেছে। আধুনিকতার অমানিশায় সুখী সমাজকে বার বার সনাতন সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছেন। আর সে কথাই স্মরণ করিয়ে মনোময়, প্রাণময়, জীবন দর্শন তুলে ধরেছেন “সাঁওতালি গান ও বিবাহরীতি” গ্রন্থে। সাহিত্যিক ও লোকগবেষক শিবরাম পত্তা সেখানেই যথার্থ এবং সার্থক রূপকার।
শিবরাম পড়া সাঁওতাল সম্প্রদায়ের একজন না হয়েও এই সমাজের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তিনি আদতে সাঁওতাল অধ্যুষিত দক্ষিণ বাঁকুড়ার মানুষ। আবার চাকরি সূত্রে তিনি দীর্ঘদিন আসানসোল পুরুলিয়ার খনি এলাকায় থেকেছেন, যে খনি অঞ্চলেও সাঁওতাল সমাজের অসংখ্য মানুষ রুটি রুজির সন্ধানে এখানে বাস করেন। আর কালো হীরার এই দেশের কালো কালো মানুষগুলিও শিবরাম বাবুর কাছে আজও হীরকখণ্ডই।
তিনি এঁদের হাসি কান্নার সঙ্গে মিশে থেকে এই সমাজটাকে দেখেছেন খুব কাছ থেকে। সাঁওতালদের পালা-পরব, নাচ-গান, সামাজিক উৎসবগুলোতে অংশগ্রহণ করতে গিয়ে নিজে যে কখন এঁদের একজন হয়ে গেছেন তা উনি নিজেও বুঝতে পারেন নি।
তাঁর সেই ভালোবাসার, ভালোলাগার অনুভূতিগুলো হঠাৎই যেন তাঁকে অস্থির করতে শুরু করে। চাকরি থেকে অবসর নেবার পরও সাঁওতাল সমাজ থেকে তিনি অবসর নিতে পারেন নি। বরং আরও ঘনিষ্ঠ হয়েছেন এই সমাজের রীতিনীতি, বিশ্বাস ও সামাজিক উৎসবগুলির সঙ্গে।
শিবরাম বাবুর এই দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা, উপলব্ধি তাঁকে সাঁওতাল সমাজের বিবাহ রীতি ও সাঁওতালি গান নিয়ে এই বই লিখতে প্রাণিত করেছে। সুতরাং এই বইয়ের (উদ্দেশ্য সাঁওতাল সমাজের বিবাহ সম্পর্কিত রীতি-নীতি, প্রথা-পদ্ধতি, তাঁদের গান, নাচ, আরণ্যক সরলতায় ভরপুর এইসব অরণ্যের সন্তানদের আবেগ, সততা, প্রেম ভালোবাসা, সামাজিক শৃঙ্খলা সম্পর্কে পাঠকদের অবহিত করা।
পাঠকদের যাতে ঠকতে না হয়, বিষয়ের প্রতিও যাতে অবিচার না হয় তাই লেখক তাঁর এই পাণ্ডিত্যপূর্ণ কাজটিকে ঝুড়িটি অধ্যায়ে লিপিবদ্ধ করেছেন। যার ফলে বইটি সাঁওতালদের উপর প্রভূত বোধ বুদ্ধিসম্পন্ন তথ্যে সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছে।
এই বই তাই সাঁওতালদের নৃতাত্বিক ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির উপর শ্রমসাধ্য তথা ক্রিয়াশীল এবং জ্ঞানসম্পন্ন একটি আলোচনা যা ছাত্র, শিক্ষক, গবেষক, নৃবিজ্ঞানী, ঐতিহাসিক সহ অনুসন্ধানী ও কৌতূহলী পাঠকদের কাছে একটি মূল্যবান দলিল এবং গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশ গ্রন্থ হিসাবে কাজ করবে।
প্রণব হাজরা………।
Reviews
There are no reviews yet.