“আমাদের ছোটবেলা, অর্থাৎ কিনা ষাটের শেষ, সত্তরের মাঝামাঝি। সে সময়ে সিনেমা দেখা খুব সহজ কিছু ছিল না। বাড়ির বড়রা সিনেমায় যেতেন, সুতরাং বাড়িতে ও পাড়ায়, তৎসহ কাগজের পাতায় সিনেমার কথা, বিজ্ঞাপন, ছবি। নিছক সিনেমা নিয়ে একাধিক জনপ্রিয় পত্রিকার আনাগোনা ছিলই বাড়িতে, উল্টোরথ, প্রসাদ, জলসাঘর ইত্যাদি, পরে আনন্দলোক। বোঝাই যায়, পরিস্থিতি ও পরিবেশ সিনেমা-অনুকূল ছিল। কিন্তু সে বড়দের, বা বখে যাওয়া স্কুল পালানো ছোটদের জন্য। দু’দলের কোনটাতেই পড়তাম না, সিনেমা দেখবার সুযোগও হতো না। বড় হওয়ার আগে, মানে ইস্কুল ছেড়ে কলেজে পা দেওয়ার আগে, অর্থাৎ শিলিগুড়ির মফস্বল ছেড়ে সত্যিকারের কলকাতা শহরে পাড়ি দেওয়ার আগে পর্যন্ত, সিনেমা হলে ঢোকার সুযোগ হয়েছে খুব কম। খুব মাঝেমধ্যে, কালেভদ্রে যে দু’একটা সিনেমা ছোটদের দেখার মতো বিবেচিত হতো, ছাড়পত্র মিলতো শুধু সেগুলোই দেখার, নইলে লবডঙ্কা। বলা বাহুল্য, খুব সুখের ছিল না ব্যাপারটা। ইস্কুল ও পাড়ার বন্ধুদের মধ্যে অনেকেই কী করে যেন টাকা বা পাস জোগাড় করে সিনেমা দেখতে চলে যেত! চুলোয় যাক স্কুল বা বাড়ি! নতুন হলে লাগা ‘বই’ নিয়ে লাগাতার কথা বলার শেষ নেই যেন, যাকে আজকাল বলে সঘন চর্চা। ‘বই দেখলি কাল?’ উত্তেজিত উত্তর আসে, ‘দেখলাম! ম্যাটিনিতে! আরি স..সাইট! ধর্মেন্দ্রর কী ফাইটিং! গানগুলাও পুরা হিট! পরের বইটাও শালা দেখবোই! বচ্চন আছে!’ আমাদের মতো ‘বাড়ির কথা শোনা ভালো ছেলে’ জাতীয় দুর্ভাগাদের কাছে এসব আলোচনা বড় মনোকষ্টের কারণ হতো বিলক্ষণ। তবু না শুনেই বা যাব কোথায়? সিনেমা তো!
এখন মাথার উপর কেবল একটা মস্ত আকাশ। যতদূর চোখ যায় শুধুই আকাশ। খানিক আগের সব বিচিত্র আকৃতির মেঘপিণ্ড এখন কেমন ম্লান হয়ে গিয়েছে। কেউ যেন তার নিজস্ব আকার ধরে রাখতে পারছে না। একেকটা মেঘপিণ্ড গিয়ে মিশে যাচ্ছে পাশেরটার সঙ্গে। সে তারও পাশেরটার সঙ্গে। আকাশ যেন একটা অনন্ত পট। নির্জনতা প্রিয় কোনও এক শিল্পী তার তুলির টানে ধূসর করে দিচ্ছে সবটা। শেষ কবে এরকম ভাবে আকাশ দেখেছে কেউ, এত অখণ্ড এক অবসর যাপন করতে করতে! অবসর! হাসি পায়! হ্যাঁ, অবসরই তো। অনন্ত অবসর। এখনই তো সময় জীবনের লাভ ক্ষতির হিসেবগুলো কষে নেবার। মনে পড়ে কত কথা। এই অসীম আকাশের নীচে শুয়ে কত কথা মনে পড়ে। আকাশ কি স্মৃতির প্রতিনিধি? কে দেবে উত্তর! কেউ দেবে না! অনুমান করে নিতে হবে। হয়। যেমন কোনওমতে শরীরটাকে একটু নড়িয়ে সে অনুমান করতে পারছে তার প্যান্টের পকেটটা হালকা। ফোন নেই। টাকার বান্ডিলগুলো নেই। টাকা! হাসতে কষ্ট হলেও একটু হাসল সে। এই টাকার জন্য তাকে এককালে কত কথাই না শুনতে হয়েছে…
Reviews
There are no reviews yet.