সুজন দাশগুপ্ত-র ফেসবুক থেকে নির্বাচিত গদ্য।

লেখকের সৃষ্ট চরিত্র একেনবাবুকে নিয়ে তৈরি হয়ে গেল চলচ্চিত্র (ওয়েব সিরিজ)। কিন্তু তাঁর নিজের ফিল্ম কেরিয়ার নিয়ে আফশোস গেল না। আসুন পড়া যাক।
 
=====
 
ছেলেবেলায় মাস্টার বাবুয়া, মাস্টার বিভুদের দেখে আমার ভারী সাধ হয়েছিল সিনেমায় নামব। বাড়ির কেউ শুনল না। অগত্যা মায়ের বন্ধু বাণীমাসিকে ধরেছিলাম। বাণী রায় তখন কবিতা-গল্প-উপন্যাস লিখে নাম করেছেন… সিনেমার লোকদের খুব চেনেন। প্রথমেই ওঁর বেয়াড়া প্রশ্ন, “তোর মা জানে?”
তখনই বুঝলাম এগোবে না, মাস্টার সুজন আর হওয়া যাবে না। এই দুঃখটাই আরও উথলে উঠেছিল, যেদিন শুনলাম আমারই পরিচিত একটি বাচ্চা ছেলে সিনেমায় চান্স পেয়ে সুচিত্রা সেনের কোলে উঠেছিল বা বসেছিল! ঠিক কোনটে মনে নেই।
 
বড় হয়েও সিনেমা নিয়ে আমার ফ্যাসিনেশন কমেনি। কলম্বাসে চাকরি করছি… শুনলাম, চেকোস্লোভাকিয়া থেকে পালিয়ে আসা এক নামকরা ফিল্ম ডিরেক্টর কোর্স দিচ্ছেন। আমি আর জো ন্যাপ (সহকর্মী) ছুটলাম, কোর্স নেব। তখন অনেক ক্লাসে বসা যেত পয়সা না দিয়েও, তবে শিক্ষকের অনুমতি লাগত। ক্লাসে ঢুকছি, দেখি ডিরেক্টর প্রশ্ন করেছেন কে কোন ডিপার্টমেন্ট থেকে এসেছে। কেউ থিয়েটার, কেউ ইংরেজি, কেউ সাইকোলজি। উত্তর শুনে ভদ্রলোক সন্তুষ্ট। ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে বললেন, “খুব ভালো, খুব ভালো। আরও ভালো তোমরা কেউ ইঞ্জিনিয়ার বা ভেটানারিয়ান নও।”
কী বিপদ! আমরা কী দোষ করলাম?
“তোমরা কোত্থেকে?” এবার আমাদের জিজ্ঞেস করলেন।
পাছে ক্লাস করতে না দেন, জো বুদ্ধি খাটিয়ে বলল, “কন্টিনিউইং এডুকেশন।”
“আমিও কন্টিনুইং।”
কী বুঝলেন কে জানে, কিন্তু ঝামেলা হল না। তবে কোর্সটা জমলই না। সারাক্ষণই মনে খচ খচ… সিনেমা আর ইঞ্জিনিয়ারিং বোধ হয় মিশ খায় না… নইলে অত বড় ডিরেক্টর ওরকম বলবেন কেন?
 
নিউ জার্সিতে এসে অবশ্য দেখলাম, সেটা সত্যি নয়। ইতিমধ্যেই দু-জন ইঞ্জিনিয়ার ফিল্ম বানিয়েছে। একজন ডকুমেন্টারি, আরেকজন বউয়ের গয়নাগাটি বেচে সোয়া দু-ঘণ্টার ফিচার ফিল্ম। সেই ফিল্মটা মুক্তিও পেল কলকাতায়। ছবির হিরো আমাদের বন্ধু। তার দিদি ঠিক করেছিল প্রথম সপ্তাহের ভিড় কমলে দেখতে যাবে। হিরোই বলল, “এ ছবি দু-দিনও চলবে না। দেখতে চাইলে কালকেই যেও।”
মোট কথা, ছবিটা পুরোপুরি ফ্লপ। সেসব দেখে আমি ঠিক করলাম, অখাদ্য ছবি বানাব না, ট্রেনিং নিয়ে ভালো ছবি বানাব।
 
ম্যানহাটনের নিউ স্কুলে ফিল্ম-মেকিং-এর ক্লাসে গেলাম। ছ-সপ্তাহের কোর্স, কোর্সের শেষে তিন-চার মিনিটের ফিল্ম প্রজেক্ট। অবশ্য একার নয়, পাঁচজন মিলে। আমাদের গ্রুপের একজন হতে চায় স্ক্রিন-প্লে রাইটার, একজন ডিরেক্টর, একজন ক্যামেরাম্যান, বাকি দুজনকে হতে হবে হিরো-হিরোইন। শেষ দুটো স্লটই ফাঁকা ছিল। হিরো আমি স্বয়ং, হিরোইন একটা ফ্রেঞ্চ মেয়ে… সে মনে হচ্ছিল বুঝতেই পারছে না কী ঘটছে।
স্ক্রিন-প্লে রাইটার একটা দুর্ধর্ষ স্ক্রিন-প্লে লিখল। রাস্তার ধারে একটা কালো ছেলে দেয়ালে ঠেস দিয়ে উদাসভাবে দাঁড়িয়ে, একটা সাদা মেয়ে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ তাকে দেখে কী জানি ভেবে ঘুরে আসবে, দু-চারটে কথা, তারপর চকাৎ করে চুমু খেয়ে চলে যাবে (হাসবেন না!)। প্রথমটা এস্টাব্লিশিং শট — লোকেশনটা বোঝাবার জন্য। তারপর ট্র্যাকিং শট… ক্যামেরা মেয়েটাকে ফলো করবে। ফিরে এসে ছেলেটার কাছে যেতেই প্রথমে মিডিয়াম শট, তারপর ক্লোজ-আপ।
 
“একটু রোল রিভার্সাল হল না।” আমি মৃদু প্রতিবাদ করেছিলাম স্ক্রিন-প্লে শুনে।
“সেটাই তো চাইছি,” সিনারিও ম্যান রেগে গেল।
সাইলেন্ট ফিল্ম। ল্যাঙ্গোয়েজ কোনও সমস্যা নয়, আমি বাংলা বলব, মেয়েটা ফ্রেঞ্চ। প্রশ্ন হল হিরোইন এটা প্লে করতে রাজি হবে কিনা। ডিরেক্টর তাকে বোঝাল। দু-একবার ফেক চুমু দেখাল। এবার ব্যাপারটা বুঝে আমার থেকে চার ইঞ্চি লম্বা মেয়েটা হেসে কুটিপাটি। কিন্তু বিশ্বাস করবেন, অ্যাদ্দূর এগিয়েও সেই ফিল্মটা হল না! গাধা ক্যামেরাম্যান কী যে ক্যামেরা চালিয়েছে, ফিল্মের পুরোটাই কালো। চুমুটা পেয়েছিলাম… কিন্তু প্রমাণ করতে পারব না।
 
এরপর আমাদের বাড়িতেই একদিন শুটিং হল… মনোজ ভৌমিকের ‘এই দ্বীপ এই নির্বাসন’ টিভি সিরিয়ালের কোনও একটা পার্টির সিন। অরিজিৎ গুহ আর সমরেশ মজুমদারের যুগ্ম প্রডাকশন ছিল বোধ হয়। বাড়ি ব্যবহার করতে দেওয়ার অনুরোধটা এসেছিল বন্ধু সিদ্ধার্থ দত্তর কাছ থেকে। অরিজিৎ আমার ছেলেবেলার বন্ধু, মনোজও বন্ধু ছিল… সুতরাং ‘না’ বলা যায় না। অভিনেতা-অভিনেত্রীরা বেশিরভাগই দেশের। পার্টি সিনে কয়েকটা স্লট ছিল। সেখানে ঢোকার চান্স ছিল একশ পার্সেন্ট… নইলে তো বাড়িই ব্যবহার করতে দেব না! কিন্তু শেষ পর্যন্ত সিনেমায় আমার কন্ট্রিবিউশন হবে শুধু একটা পার্টিতে সরবত (ঠিক আছে না হয় হুইস্কি) খাওয়ার রোলে? মন সাড়া দিল না। শুনেছি এই সিরিয়ালটাও মুক্তি পায়নি, অনুমতি সংক্রান্ত কারণে।
 
অভিনয় দিয়ে শুরু করেছিলাম, সেখানেই ফিরে আসি। আমার নিজের বয়সটা ঠিক রেখে সময়টাকে যদি পঞ্চাশ-ষাট বছর পিছিয়ে দিতে পারতাম, তাহলে একটা চান্স ছিল। সেকালে বহু বাংলা সিনেমায় দু-তিন মিনিটের একটা মৃত্যুর সিন থাকত। বৃদ্ধ হাঁপাচ্ছেন আর কাশছেন। খাটের চারপাশে বাড়ির মহিলারা মুখে আঁচল চাপা দিয়ে কান্না চাপার চেষ্টা করছেন। বাড়ির বড়রা বাবার পা ধরে বসে আছে, নাতি-নাতনিরা দাদু-দাদু করছে। বৃদ্ধ হাঁপাতে হাঁপাতে কাশতে কাশতে তাঁর আশীর্বাণী বর্ষণ করছেন। ওই রোলটা আমি পেলে ফাটিয়ে দিতাম। এমনিতেই আমার অ্যালার্জি, দিনরাত কাশিও খুব, ন্যাচারাল অ্যাডভান্টেজ ছিল। কিন্তু সে যুগ তো এখন নেই। এখন তো সেরকম সিনই দেখি না, সবকিছু সিম্বলিক!
 
তাহলে দাঁড়াল কি? কী আবার? সিনেমা ‘করেছে আড়ি, আসে না আমার বাড়ি, গলি দিয়ে চলে যায়…’
Weight 0.3 kg
Dimensions 21 × 18 × 2 cm
Author Name

Binding

ISBN

978-93-86937-22-3

Language

Publisher

Publishing Year

2023

Reviews

There are no reviews yet.

Be the first to review “Sujankatha || Sujan Dasgupta”

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Recently Viewed

  • Recently Viewed Products is a function which helps you keep track of your recent viewing history.
    Shop Now
Sujankatha || Sujan Dasgupta
Original price was: ₹125.Current price is: ₹113.

Only 5 left in stock

Estimated delivery on 25 - 29 November, 2024