রতিকান্তর জীবন রাত্রির কাছে আশ্চর্য ঋণী হয়ে আছে। রাত যেন তার কাছে অদ্ভুত মায়া নিয়ে হাজির হয়। রতিকান্ত বলে মায়া চাদর। সেই মায়া চাদর গায়ে দিয়ে সে জীবনের সমস্ত তিমিরহননে প্রয়াসী হয়। পরিকল্পনা করে। সে জানে অন্ধকারই আসলে তাকে হাত ধরে আলোর দরজার কাছে নিয়ে এসে দাঁড় করায়। তারপরে আলতো স্পর্শে খুলে যায় দরজা। দরজায় দাঁড়িয়ে রতিকান্ত অপেক্ষা করে। বাইরে কাক ডেকে উঠল কোথাও। কাক ডাকার শব্দে বড় অস্বস্তি হয় রতিকান্তর। অনেকক্ষণ বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করেছে আর মাথার ভিতরে একরাশ চিন্তা, একরাশ মাকড়শা অজস্র পায়ের দাপটে হেঁটে বেড়িয়েছে। ফলে ঘুম না আসা অবশ্যম্ভাবী। তবু একটা মিহি তন্দ্রার আবেশ সবে তাকে জড়িয়ে ধরতে চেয়েছে তখনই কাক ডাকল। মনে হলো ভীত-সন্ত্রস্ত কাক মৃত্যুযন্ত্রণার মতো হিমডাকে স্তব্ধ অন্ধকারকে ফালা ফালা করে দিচ্ছে। রতিকান্ত সত্বর বাইরে বেরিয়ে আসে। বাড়িটির কিছু পরিবর্তন ঘটেছে। বাগানে নতুন কিছু গাছ বসানো হয়েছে। নতুন এক মালি রেখেছে সে। বাইরে বেরিয়ে দেখল নিকষ অন্ধকার। সে বাগানে নেমে এসে মাথার উপরে আকাশের দিকে তাকায়। কোথাও কোনও আলোর চিহ্নমাত্র নেই। সে বুঝতে পারল সারা আকাশ গভীর কালো মেঘে ঢেকে আছে। এক তুমুল বৃষ্টির অপেক্ষায় সমস্ত চরাচর তৃষিত হয়ে আছে। কয়েকদিন থেকে ভীষণ গুমোটে গাছপালা যেন ক্লান্ত হয়ে ঝিমিয়ে পড়েছে। তাদের পাতায় পাতায় বাতাসের কোনও আন্দোলন নেই। রতিকান্ত সেই ক্লান্ত, তৃষিত উদ্যানের ঘাসের উপরে পায়চারি করছিল। হঠাৎ কোথা থেকে উদয় হলো ভীম সর্দার। তার হাতে ক্ষীণ আলোর এক লন্ঠন। এতো রাতে ভীম সর্দারকে এখানে দেখে অবাক হলো রতিকান্ত। সে তো হুগলি গিয়েছিল। রতিকান্ত তাকে কিছুদিন থেকে হুগলিতে তার দেশের গ্রামে পাঠাচ্ছে। কিছু জমিজমা কিনেছে। পুরোনো বাড়িটা নতুন করে নির্মাণ করাবার ইচ্ছা আছে তার। সেই কারণেই ভীম আর বাজার সরকার দেবদুলালকে সেখানে প্রেরণ করেছিল সে। দেবদুলাল বড় চৌকস ছেলে। বয়স অল্প কিন্তু যেমন কাজের তেমনি ধূর্ত। দিনে দিনে সে রতিকান্তর ডানহাত হয়ে উঠেছে।
হুগলিতে জমিজমা কেনবার কোনও প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু রতিকান্ত যেন হুগলি যাবার একটা অজুহাত খুঁজে বেড়াচ্ছে। যে দেশে সুধাময়ীর বাস সেখানে রতিকান্তকে একবার ফিরে যেতেই হবে। কিন্তু কেন? কিংবা কবে? তা রতিকান্ত জানে না। এমনকী সে সঠিক জানে না সুধাময়ী কেমন আছে, কীভাবে আছে! কিন্তু তার ভীষণভাবে জানতে ইচ্ছা করে। মুখ ফুটে সে একবার এই বিষয়ে খোঁজ নেবার কথা বলবে ভেবেছিল ভীমকে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনও এক সংকোচে বলে উঠতে পারেনি।
Reviews
There are no reviews yet.